রাকসু নির্বাচন: ছাত্ররাজনীতি সুস্থ ধারায় ফেরার ভোট আজ

প্রকাশিত: 16 Oct 2025, 09:39
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। প্রায় ৩৫ বছর পর বহুল প্রতীক্ষিত এ ভোটযুদ্ধ ঘিরে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে ৪৩ পদে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলে ৯১৮ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে লড়ছে ছাত্রদল সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক পরিষদ মিলে ১১টি প্যানেল। ভোটাররা বলছেন, নির্বাচনে শুধু একক কোনো পরিষদের প্রতি সমর্থনের চেয়ে ব্যক্তিত্ব, সততা ও কাজের মানসিকতা দেখে ভোট দেবেন তারা। একই সঙ্গে কারা ঘোষিত ইশতেহার বাস্তবায়নে সক্ষম, সেটিও দেখবেন ভোটাররা। রাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ২৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে পুরুষ প্রায় ৬১ ও নারী ৩৯ শতাংশ। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোটারদের কেন্দ্রীয় সংসদে ২৩টি, হল সংসদে ১৫টি এবং সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে পাঁচটি পদ মিলিয়ে ৪৩টি ভোট দিতে হবে। এসব ভোট দিতে ভোটারের জন্য বরাদ্দ থাকবে ১০ মিনিট অর্থাৎ প্রতিটি ভোট দিতে গড়ে প্রায় ১৪ সেকেন্ড করে সময় পাবেন ভোটাররা। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়ানো ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। ১৭ কেন্দ্রের ৯৯০ বুথে হবে ভোটগ্রহণ। থাকছে না অতিরিক্ত ব্যালট পেপার ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার ছাপানো নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ওই বিতর্ক এড়াতে অতিরিক্ত ব্যালট না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাকসু নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের আগের দিন গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল আকন্দ জানান, পৃথিবীর কোথাও অতিরিক্ত ব্যালট পেপার দেওয়া হয় না। আমাদের ভোটার সংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১, আমরা ২৮ হাজার ৯০১টি ব্যালটই ছাপিয়েছি। একটিও বেশি-কম ছাপানো হয়নি। সব কেন্দ্রে নির্ধারিত ব্যালট পেপার পাঠানো হবে। এখানে কম-বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বিতর্ক এড়াতে ব্যালট পেপার যেনতেন কোনো জায়গা থেকেও প্রিন্ট করানো হয়নি। নামসর্বস্ব কোনো প্রেসের কাছে এটি প্রিন্টের জন্য দেওয়া হয়নি। যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন বা পরীক্ষার কাজ করে, তাদের কাছে থেকে করানো হয়েছে। ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ফল প্রকাশের আশা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে সময় লেগেছিল ৫২ ঘণ্টা। ভোট গণনাকালে ঘটে এক শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনাও। তাই ছাত্রদল সমর্থিত পরিষদ আপত্তি জানালেও অধিকাংশ প্যানেল হাতে গণনার বিরোধিতা করে ওএমআর মেশিনে গণনার দাবি জানায়। সে অনুযায়ী রাকসুর ভোট গণনা এ পদ্ধতিতেই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে ভোটগ্রহণ শেষের ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ফল প্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলাম বলেন, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ভোট গণনা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। আমরা ভোট গণনার জন্য সর্বোচ্চ আধুনিক ওএমআর মেশিনের ব্যবস্থা করেছি। ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ফল ঘোষণা করা হবে। ১৭ হলের জন্য ১৭টি ভোটকেন্দ্র করা হয়েছে। ভোটারদের পৃথক ছয়টি পেজ ও আলাদা রঙের ব্যালট পেপার দেওয়া হবে। ব্যক্তিত্ব ও কাজের মানসিকতা দেখে ভোট ডাকসু ও জাকসুর মতো রাকসু নির্বাচনেও প্যানেলের চেয়ে প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, সততা ও কাজের মানসিকতা দেখে ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ত্বাসিন সিদ্দিকা রুপা আমার দেশকে বলেন, ‘আমি আসলে প্যানেল ও দলের বাইরে গিয়ে যারা এতদিন বিভিন্ন আন্দোলনে ছিলেন বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাদের বিবেচনায় রাখতে চাইছি। যারা আসলেই অ্যাক্টিভিস্ট এবং ক্যাম্পাস সংস্কারে সোচ্চার ছিল, তাদের বিবেচনায় রাখতে চাই। ইশতেহার দেখে নয়; বরং বিগত সময়ে তাদের অবদান দেখে আমি প্রতিনিধি নির্বাচন করব।’ আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী নুরুল্লাহ আলম নূর বলেন, ‘বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে ইশতেহারগুলো দিয়েছে, সেগুলোর অনেকটাই বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। আমার মনে হয়, ইশতেহারের চেয়ে প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, সততা ও কাজের মানসিকতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভোট দেওয়ার সময় আমি সেটাই বিবেচনা করব।’ ভিপি পদে শিবির প্রার্থীর আধিপত্যের সম্ভাবনা রাকসু ভোটে আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলিয়ে অন্তত ১১টি প্যানেল অংশ নিচ্ছে। এর বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছে আরেকটি অংশ। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও স্বতন্ত্র কয়েকজন প্রার্থী এগিয়ে আছেন বলে জরিপ ও শিক্ষার্থীদের আলোচনায় উঠে এসেছে। এর বাইরে রাকসুর একমাত্র নারী ভিপি প্রার্থী তাসিন খান, আধিপত্যবাদবিরোধী ঐক্য, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও বাম জোট সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরাও আলোচনায় আছেন।তবে ডাকসু, জাকসুতে শিবিরের পুরো প্যানেল জয় পাওয়ার পর রাকসুতেও অনুরূপ ফলের আভাস মিলছে শিক্ষার্থীদের ভাষ্যে। সবার নজর ভিপি ও জিএস পদের দিকে। ভিপি পদে ছাত্রশিবির মনোনীত মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বড় ব্যবধানে জিততে পারেন বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে জিএস পদে দুই সাবেক সমন্বয়কের মধ্যে হতে পারে মূল লড়াই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রশিবির মনোনীত সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজার সঙ্গে লড়বেন সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দীন আম্মার। শুরু থেকেই সব থেকে বেশি আলোচনায় আছেন তারা। এজিএস পদে ছাত্রদলের জাহীন বিশ্বাস এষার সঙ্গে শিবিরের সালমান সাব্বিরের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া অধিকাংশ পদে ছাত্রশিবির প্যানলের প্রার্থী জয় পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবেন তা নির্ভর করছে নারী ভোটার, অনাবাসিক শিক্ষার্থী ও প্রথম বর্ষের ভোটারদের ওপর। শেষ পর্যন্ত জয়-পরাজয়ের সমীকরণে এসব ভোটার পার্থক্য গড়ে দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোট ভোটারের ৬৮ শতাংশ অনাবাসিক। নারী ভোটার প্রায় ৩৯ শতাংশ, সংখ্যায় যা ১১ হাজার ৩০৫। শিক্ষার্থীরা বলছেন, নারী ভোটারদের ভোট যারা বেশি পাবেন, তাদেরই জয়ী হওয়ার সম্ভবনা বেশি। ভোটারদের আনতে চার চ্যালেঞ্জ রাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু ও ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ভোটারদের কেন্দ্রে আনাসহ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অনাবাসিক ভোটারদের অংশগ্রহণ, পরিবহন নিশ্চিত করাসহ চারটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী শেখ নুরুদ্দিন আবির আমার দেশকে বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু হচ্ছে, ভোট নিয়ে ভীষণ আগ্রহী শিক্ষার্থীরা। তবে কিছু শিক্ষার্থীর অনীহা থাকায় হয়তো কেউ কেউ ক্যাম্পাসে আসতে চাইবেন না। আমরা সব ব্যাচের ক্যাপ্টেনদের বলেছি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো জন্য।’ ছাত্রশিবির সমর্থিত ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ আমার দেশকে বলেন, ‘হলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি হলে উপস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। আমাদের প্রায় চারভাগের তিনভাগ শিক্ষার্থী যেহেতু বাধ্য হয়ে বাইরে থাকেন, প্রশাসনের প্রতি জোর আহ্বান করছি পরিবহন ব্যবস্থা যেন ভালো হয়।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন প্রশাসক ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার আমার দেশকে বলেন, ‘আমাদের আবাসিক সংকট আছে। অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীকে বাইরে থাকতে হয়। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে রাজশাহী শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে ২৫টি বাস থাকবে ক্যাম্পাসে আসার জন্য। সব শিক্ষার্থীকে আমরা ক্যাম্পাসে আনতে চাই। অন্যান্য দিন চারটি ট্রিপে বাস এলেও বৃহস্পতিবার আটটি ট্রিপে বাস আসবে।’ এর বাইরে ৯টি ভেন্যুর ১৭টি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের কোনো আশঙ্কা নেই। ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার প্রশ্নও উঠছে না। আমরা সেভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।’ ক্যাম্পাসের বাইরে বিশৃঙ্খলার ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মাঈন উদ্দীন খান আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানিয়ে রেখেছি। যেহেতু এটা ক্যাম্পাসের বাইরের বিষয়, এটা আমাদের পক্ষে কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়। ক্যাম্পাসের ভেতরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটলে সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন মিলে সামাল দেবে।’ ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতাকে ঘিরে প্রশ্নরাকসুর আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ক্যাম্পাসে ঢুকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে অবস্থান করতে দেখা গেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাংগাঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমানকে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যায় তাকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান বলেন, ‘আশ্চর্য! সে কীভাবে ভেতরে ঢুকল, তা আমাদের জানা নেই। সব গেটে চেকপোস্ট আছে, আমরা কঠোর নিরাপত্তা দিচ্ছি। তারপরও কীভাবে সে প্রবেশ করল, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’ রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. নজরুল বলেন, তিনি ঢুকলেন কীভাবে? তার তো এখানে আসার কথা নয়। আচ্ছা, বিষয়টি আমি দেখছি।’ তবে এ বিষয়ে জানতে ছাত্রদল নেতা আমানউল্লাহ আমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
📘 ফেসবুক ▶️ ইউটিউব